এই শুক্রবারের জুমুআর খুতবার সারমর্ম (৯ ডিসেম্বর, ২০২২): আলহামদুলিল্লাহ, শুকরিয়া আর ধন-দৌলত মাসজিদ
এই শুক্রবারের জুমুআর খুতবার সারমর্ম (৯ ডিসেম্বর, ২০২২): আলহামদুলিল্লাহ, শুকরিয়া আর ধন-দৌলত
মাসজিদ-আল-জামিয়া, ফিলাডেলফিয়া, পেনসিলভানিয়া।
ইমাম খুতবা শুরু করলেন শুকরিয়া আর আলহামদুলিল্লাহর মধ্যে পার্থক্য কী সেটা বলে। বললেন, শুকরিয়া হচ্ছে ধন্যবাদ জ্ঞাপন, আর আলহামদুলিল্লাহ হচ্ছে হামদ বা প্রশংসা করা যেটা কিনা শুকরিয়া বা ধন্যবাদকেও যুক্ত করে। এরপর একটা কথা বললেন যেটা শুনে একটু ধাক্কা খেলাম: বললেন, আজকে মসজিদে আমরা যারাই উপস্থিত আছি, তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত সৌভাগ্যবান, স্মার্ট বা বুদ্ধিমান এবং সম্পদশালী! ইমাম নিজেই প্রশ্ন করলেন, আমরা হয়তো ভাবছি, আলহামদুলিল্লাহ আর এর পরে মসজিদে উপস্থিত থেকে সৌভাগ্যবান, বুদ্ধিমান আর ধনী বা সম্পদশালী হওয়ার মধ্যে কী সম্পর্ক থাকতে পারে? আরো বললেন, আমরা হয়তো ভাবছি যে ঠিক আছে, আমরা মুসলিম, আল্লাহ তা'য়ালা আমাদেরকে আজকে এই মসজিদে উপস্থিত হওয়ার তৌফিক দিয়েছেন, সেইজন্য আমরা নাহয় সৌভাগ্যবান; অন্য কাজ বাদ দিয়ে শুক্রবারের জুমুআর খুতবা শুনছি - জুমুআর খুতবা আর নামাজ আদায় করা অন্য কাজের থেকে গুরুত্বপূর্ণ - সেইটা উপলব্ধি করে আমরা নাহয় বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিচ্ছি, কিন্তু আমরা সবাই যে ধনী কিংবা সম্পদশালী - সেটা কী করে সম্ভব, সেটার হিসাব তো মিলছে না?!
এরপর ইমাম প্রতিজ্ঞা করে বললেন, তিনি নিশ্চিত যে মসজিদে উপস্থিত আমরা সবাই সাহাবী আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে ধনী, এমনকি আমাদের রাসূল (সাঃ) - থেকেও অর্থ-বিত্তে ধনী - এই ব্যাপারে তাঁর কোনো সন্দেহ নাই। তবে তিনি ধনী বলতে টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ির হিসাবে কাউকে ধনী বলছেন না - কী কারণে ধনী বলছেন - সেটা একটু পরেই বুঝিয়ে বলছেন।
ইমাম বললেন, আমরা স্বভাবতই আমাদের জীবন নিয়ে, দৈনন্দিন সমস্যা, অসুবিধা নিয়ে অভিযোগ করি। কিন্তু আমরা অনেক সময় এই অভিযোগ করার মাত্রা এতটাই বাড়িয়ে দেই যে, সেটা যে আমাদের শরীর-স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে, সেটা বুঝি না। ইমাম বললেন, আমাদের মস্তিষ্ক এমন যে কোনো বিপদ বা সমস্যা আসলে সেটা শরীরকে "ফ্লাইট অর ফাইট" - অর্থাৎ ভেগে যেতে কিংবা তা মোকাবেলা করতে প্রস্তুত করে। মস্তিষ্ক একটা হরমোন [নাম বলেছিলেন, আমার মনে নাই] নিঃসরণ করার নির্দেশ দিয়ে সেটা করতে সাহায্য করে। কিন্তু ঘনঘন এই ঘটনা ঘটতে থাকলে শরীরের উপর চাপ পড়ে। উল্টো দিকে, আমরা যখন 'আলহামদুলিল্লাহ' বলে কৃতজ্ঞ হই, তখন আমাদের মনে একটা 'পজিটিভ' ভাব আসে, সেটা আমাদেরকে আশাবাদী করতে সাহায্য করে, যেটা পক্ষান্তরে আমাদের মনের চাপ কমায়, শরীর ভালো রাখতে সাহায্য করে। ইমাম উদহারণ দিয়ে বললেন, আমাদের রাসূলের (সাঃ) সুন্নত হচ্ছে, ঘুম ভাঙার পরপরই "আলহামদুলিল্লাহ" বলে দিন শুরু করা।
এরপর বললেন, ধরা যাক, আজকে সবাই যার যা ইচ্ছা তাই-ই পেয়ে যাচ্ছে। টাকা-পয়সা সবার সমান পরিমান, আর অঢেল পরিমান আছে, কারো কোনো অভাব নাই । এরপর মজা করে প্রশ্ন করলেন, ধরা যাক, আজকে স্বামী -স্ত্রী প্রত্যেকেই মিলিয়ন ডলারের মালিক, তাহলে কী সেই স্ত্রী আর তার স্বামীর জন্য রান্না করবে? স্ত্রী বলে বসবে আমি রান্না করবো কেন, যাও রেস্টুরেন্ট থেকে আনিয়ে খাও। রেস্টুরেন্টে গেলে দেখা যাবে, রেস্টুরেন্টের মালিক বা কর্মচারী কেউই নাই, সবাই যেহেতু অঢেল টাকার মালিক, কারো আর কাজ করার দরকার নাই - খাবার নাই। এভাবে আমরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করে ফেলবো। আর তাই, আমরা একে-অপরের স্বার্থেই, নিজেদের রক্ষা করার তাগিদেই আল্লাহ তা'য়ালার ইচ্ছায় কেউ কম-কেউ বেশি ধন-সম্পদের মালিক। একে ওপরের উপর নির্ভরশীল, কেউই স্বয়ংসম্পূর্ণ নই।
এরপর ইমাম সূরা মূলকের (সূরা নম্বর ৬৭, আয়াত ২৩) তিলাওয়াত করলেন, যার অর্থ অনেকটা এই রকম: "বলুন (হে রাসূল), তিনিই তোমাদের তৈরী করেছেন, এবং তোমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি আর অন্তর দিয়েছেন - তবে তোমরা খুব কমই তাঁর শোকর করো।" এরপর বাকি খুতবা জুড়ে ইমাম এই আয়াত নিয়েই আলোচনা করলেন। বললেন, মানুষ তাঁর নিজের সৃষ্টির পিছনে, শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি আর অন্তরের জন্য কোনোভাবেই কিছু খরচ না করেই যে সব বিনামূল্যে পেয়ে যায়, আর তাতেই সে ভাবে এইগুলোর সে দাবিদার। [সাইডনোট: ইমাম নিজে ডাক্তার কিনা জানি না, কিন্তু প্রচুর ডাক্তারি রেফারেন্স দিয়ে বাকি খুতবা দিলেন]। আমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি যে কতটা ডেলিকেট বা সুক্ষ - সেটা বললেন। আমরা কান দিয়ে শুনি আর চোখ দিয়ে দেখি, কিন্তু এই শোনা কিংবা দেখা যে কত মিলিয়ন কোষের সমন্বয়ে হয়, কত মিলিয়ন ক্যালকুলেশন বা হিসাব যে আমাদের মস্তিক্ষে ঘটে - যার কারণে আমরা আমাদের চারপাশের অবস্থা বুঝি, শুধু তাই না, সেটার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেই - তা কী কখনো আমরা ভেবে দেখেছি? দুই কানের কারণে যে আমরা ভারসাম্য বজায় রেখে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারি, সেটা কী ভেবে দেখেছি? ইমাম এরপর আরো বললেন [এবারেও প্রচুর ডাক্তারি রেফারেন্স দিয়ে] আমরা যে স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নিচ্ছি, সেটা ঘটাতে আমাদের ফুসফুস যে কত ডেলিকেট বা সুক্ষভাবে কাজ করছে, কিংবা আমাদের হৃদপিন্ড যে এক মুহূর্তের জন্যও না থেমে এই পর্যন্ত কত মিলিয়নবার ধুক-পুক করেছে - সেটার জন্য কী আমরা কোনো টাকা পয়সা খরচ করেছি? আজকে যে অসুস্হ, যার হয়তো কোনো একটা অর্গান ঠিকমতো কাজ করছে না - কেবল সেইই এই নেয়ামত গুলোর প্রকৃত মূল্য বোঝে। অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে চিকিৎসা করিয়ে সে সুস্থ হতে চায়। এইরকম অসুস্হ ব্যক্তির কাছে তখন দুনিয়ার আর কোনো ধন-সম্পদ আর মূল্যবান মনে হয় না। আর আমরা যারা আজকে সুস্হ আছি, ভালো আছি - তারা কী এইসব নেয়ামতের জন্য অন্তত ২ রাকাত নামাজ পড়ে কোনোদিন শুকরিয়া আদায় করেছি? আর তাই-ই আল্লাহ ওই আয়াতে বলছেন: "তোমরা খুব কমই শোকর করো"!
ইমাম বললেন, এইসব নেয়ামতের অধিকারী আমরা সবাই আসলে "ধনী"। আমাদের অন্যান্য অনেক ঝামেলা আছে, আর্থিক অনটন হয়তো আছে, কিন্তু মনে রাখতে হবে, এইসব আছে দেখেই আমরা একে ওপরের উপর নির্ভরশীল, আর জীবনটা এতো সুন্দর। কাজেই, যার যত অসুবিধাই থাকুক না কেন, আল্লাহ তা'য়ালার শুকরিয়া আদায় করার জন্য, প্রশংসা করার জন্য, আলহামদুলিল্লাহ বলার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনে কিছু না কিছু আছে।